আদর্শ টিভি 24/7 - দেশ ও জনগণের কল্যাণে..... |
ভারত ও পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হিসেবে স্বীকৃত হলেও এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সাথে ভারতের এক প্রকার বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এরা প্রায় সকলেই ছিলো ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব বলয়ের অধীনে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে উত্থান ক্রমশই দক্ষিণ এশিয়ার এ বাস্তবতাকে বদলে দিচ্ছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - শ্রীলংকায় চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও নৌ-চুক্তি সম্পাদন। নেপালের কমিউনিস্ট সরকারের সাথে চীনের বিশেষ সখ্যতা এবং সড়ক যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ। এছাড়াও বাংলাদেশের সাথে ধারাবাহিকভাবে চীনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ এবং অবকাঠামো নির্মাণ ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। অপরদিকে, ভুটানের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক বিষয়ে অতিরিক্ত ভারত-নির্ভরতা যেমন দেশটিকে নতুন করে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী করছে, ঠিক তেমনিভাবে মালদ্বীপের মতো দেশও ইদানিংকালে বহুলাংশে অর্থনৈতিকভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ঐতিহাসিক বন্ধু পাকিস্তানের কথা বলাই বাহুল্য।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’র অংশ হিসেবে পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ ও ঋণ সুবিধা প্রদান এবং অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা ভারতের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারীতে পুরো বিশ্ব যখন টালমাটাল এবং বিশেষ করে এই রোগের উৎপত্তিস্থল চীনের দিকে যখন অনেক রাষ্ট্রের অভিযোগের তীর, এমন সময়ে লাদাখ সীমান্তে মাসব্যাপী চীন-ভারত সামরিক বিরোধ অতিসম্প্রতি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ পর্যন্ত গড়িয়েছে। ফলশ্রুতিতে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একমাত্র আস্থাভাজন রাষ্ট্র হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে?
স্বাধীনতা লাভের শুরু থেকেই বাংলাদেশের সাথে ভারতের এক ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বিভিন্ন আমলে খানিকটা উত্থান-পতন পেরিয়ে গত এক দশক যাবৎ বর্তমান আওয়ামী-লীগ সরকারের অধীনে এ সম্পর্ক একটি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিলো প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ২০১৯ সালে এসে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে অনেক। এই এক দশকে বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগও বেড়েছে কয়েকগুণ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশে মাত্র ৫.৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছিল। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেড়ে হয় ১২৫.২ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১৩.৭ মিলিয়ন ডলার।
বর্তমান মোদি সরকারের আমলে ভারত বাংলাদেশের জন্য তার ‘বার্ষিক সহায়তা বাজেট’ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রায় ১৯৭ কোটি রুপি থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭৮ কোটি রুপিতে নামিয়ে এনেছে। যদিও ২০১০, ২০১৫ ও ২০১৭ সালে ভারত বাংলাদেশকে তিনটি ঋণচুক্তির অধীনে সর্বমোট প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গত এক দশকে এই দুই দেশের অন্যতম বড় অর্জন ছিলো ২০১১ সালের ‘স্থল সীমানা চুক্তি’। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার ছিটমহল সমস্যা ও অমীমাংসিত স্থল সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়। তবে বিগত বছরগুলোতে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে প্রতিনিয়ত বহু বাংলাদেশি নাগরিক প্রাণ হারাচ্ছে। এমনকি চলমান লাদাখ বিরোধের মাঝেও সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বিএসএফের তথাকথিত ‘হত্যার জন্য গুলি’ নীতি বাংলাদেশি নাগরিকদের মাঝে ভারতের প্রতি ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত বছর ভারতের আসাম রাজ্যে ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জী’ (এনআরসি) তৈরি। আর তা থেকে প্রায় ১৯ লক্ষ জনগণের বাদ পড়া এবং ভারতের লোকসভায় ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের বিধান রেখে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল’ (সিএবি) পাস বাংলাদেশের জন্য এক নতুন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার ভারতের উপর এক প্রকার আস্থা রেখেই একে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছে। আলোচ্য দশকে দুই দেশের মাঝে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, এবং বৈজ্ঞানিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলেও অমীমাংসিত থেকে গেছে তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বর্তমান সরকার ভারতের অখণ্ডতা রক্ষাসহ বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহন করলেও রোহিঙ্গা সমস্যার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভারতকে পাশে না পাওয়া ছিলো বাংলাদেশের জন্য চরম হতাশার।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা করলেও ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীন কৌশলগত অংশীদারি চুক্তির মাধ্যমে সামরিক ও বেসামরিক ভাবে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী। বর্তমানে চীনের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি। তবে সম্প্রতি চীনের বাজারে প্রায় ৯৭ শতাংশে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ঘোষণা দুই দেশের বাণিজ্য আরো সম্প্রসারণ করবে ও ঘাটতি কমিয়ে আনবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ঘোষণাটি এমন সময় আসে যখন চীন-ভারত লাদাখে মুখোমুখি সামরিক অবস্থানে। তাই এটি মনে করা স্বাভাবিক যে উক্ত পরিস্থিতিতে চীন বাংলাদেশকে তার পাশে চাইছে। বিগত কয়েক বছরে চীন বাংলাদেশকে সর্বমোট প্রায় ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তাছাড়াও অবকাঠামো নির্মাণে বর্তমানে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সহযোগী। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে লক্ষ করলে দেখা যায়, ২০০২ সাল থেকেই চীনের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের ‘প্রতিরক্ষা সহযোগীতা চুক্তি’, আর পাশাপাশি চীনের উৎপাদিত অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম তুলনামূলক সস্তা ও সহজ-শর্ত ঋণের আওতায় কেনার সুযোগ থাকায় কয়েক দশক ধরেই এসবের জন্য বাংলাদেশ মূলত চীনের উপর নির্ভরশীল।
ইদানিংকালে চীন থেকে আমদানিকৃত সাবমেরিন, মিসাইল ফ্রিগেট, করভেটসহ বিভিন্ন যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য উন্নত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বাংলাদেশের সামরিক সামর্থ্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এছাড়াও চীন বাংলাদেশে একাধিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ ও পায়রায় আধুনিক সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সম্পৃক্ত। তবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চীনের সাথে বাংলাদেশের সহযোগিতা এখনো অনেক পিছিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপড়েন মূলত রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে। এ সমস্যা সমাধানে চীন বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়িয়ে বরং মিয়ানমারকেই প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে এসেছে, যা বাংলাদেশের জন্য ছিলো খুবই অস্বস্তিকর।
দুই দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের যখন এই হাল তখন চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে চলমান বিরোধ কিংবা ভবিষ্যতে তাদের মধ্যকার যেকোন সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে এটি স্পষ্টভাবেই বলা আছে, বাংলাদেশ যেকোন দেশের সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ হস্তক্ষেপ করবে না। পাশাপাশি, সবসময়ই যেকোন আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান। ঐতিহাসিক বাস্তবতাও আমাদেরকে বাংলাদেশের এমন চরিত্রই নির্দেশ করে। বর্তমান সরকারের অধীনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক-কূটনীতির মাধ্যমে দেশের চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা এবং বিশ্বে দেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার দ্বারা বৈদেশিক বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শ্রম বাজার সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত করা। অর্থনীতির পাশাপাশি, দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখাও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য।
এই মর্মে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সন্ত্রাসবাদ দমন এবং রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। তাই বাংলাদেশ প্রথমত কখনই চাইবে না চীন-ভারত কোন যুদ্ধে লিপ্ত হোক। কারণ তা আঞ্চলিক অস্থিরতা বাড়াবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। দ্বিতীয়ত, যেকোন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষভাবে কোন পক্ষাবলম্বনের সম্ভাবনা নেই। কারণ উপরোক্ত আলোচনা থেকে দুই দেশের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট।
তবে একটি বিষয় অনুমেয় যে, চীন-ভারতের মাঝে চলমান উত্তেজনা যুদ্ধ পর্যন্ত না গড়ালেও দীর্ঘায়িত হবে আর ফলশ্রুতিতে দুই দেশই একে-অপরের উপর অর্থনৈতিক কঠোরতা আরোপ করবে। যার সুফল পেতে পারে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ। এমনকি অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী উক্ত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে বিকল্প হিসেবে বেছে নিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ‘বাস্তববাদ’ তত্ত্বের নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই বাংলাদেশ তার কর্মকাণ্ড পরিচালিত করবে। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট যেকোন বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য যে সুযোগ আসবে তা সে নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেবে এবং তা থেকে সুফল আদায়ের চেষ্টা করবে। এটা অনেকটা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আচরণের সাথে তুলনীয়। তবে এক্ষেত্রে অনেক কিছুই নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক সক্ষমতার উপর।